গণমানুষের কবি নজরুল
- রফিকুল ইসলাম রফিক ০৩-০৫-২০২৪

রবীন্দ্রযুগে যে সমস্ত মুসলমান কবিগণ তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন- তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি হলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যে বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও বিশেষত কবি এবং বিদ্রোহী কবি হিসেবে তিনি স্বনামধন্য। আর তার এই বিদ্রোহের পেছনে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে – সেটি হলো তার মানবতাবোধ। সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালবাসা, অন্তরের দরদ। তাই তিনি মানবতার কবি গণমানুষের কবি।
কবি নজরুল ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন বর্ধমানে। দরিদ্র পরিবারের এই শিশুটি শৈশবেই হারান পিতাকে। মাতৃস্নেহও পাননি বেশিদিন। মাকে হারিয়ে মাতৃভুমির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে পড়েন নজরুল। দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে সেই কিশোর বয়স থেকেই কবিকে করতে হয়েছে বিচিত্র জীবিকার সন্ধান। মক্তবের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মাজারের খাদেমগিরি,লেটোর দলে যোগদান, রুটির দোকানে কাজ ইত্যাদি কত না কাজ করতে হয়েছে কবিকে। এমনিভাবে শৈশবের এক নিদারুণ বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা নিয়ে নজরুল পদার্পণ করেছেন যৌবনে। দরিদ্র- অসহায় মানুষের জীবনের কঠোর অভিজ্ঞতায় হয়েছেন সমৃদ্ধ। তাই সাধারণ মানুষের প্রতি কবির গড়ে ওঠে এক অপরিহার্য অঙ্গীকার। আপন জীবনের দুঃখের অভিজ্ঞতার দর্পণে তিনি দেখেছেন এদেশের সাধারণ মানুষের জীবন। তাই তো কবির- হৃদয় নিংড়ানো শপথ – ক্ষুধার জোরেই করবো এবার সুধার রাজ্য জয়। ক্ষুধা, দারিদ্র নজরুলকে পরাভূত করতে পারিনি। বরং জগৎ জয়ের স্বপ্নে করেছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই তো তিনি দারিদ্রকে ঘৃণা না করেছেন আলিঙ্গন। কবি গেয়েছেন-
হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ খৃষ্টের সম্মান।
সাধারণ কবি হিসেবে নজরুলের অঙ্গীকার প্রকাশিত হয়েছে তার অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, ফণীমনসা, ভাঙ্গার গান, সর্বহারা প্রভৃতি ক্যাবে। তার যুগবানী ও সাংবাদিক গদ্যে। নজরুল সমগ্র উপমহাদেশীয় তরুণ সমাজ ও গণমানুষের মনোভাবকে ভাষারূপ দিয়েছেন তার কবিতায়।
কবি বিদ্রোহীর প্রথম অনুচ্ছেদে হিমালয় শৃঙ্গকে পদানত করে মহাবিশ্বের দিকে ধাবিত করেছেন। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-তারা, ভুলোক- দ্যুলোক ভেদ করে – খোদার আসন আকাশ ছেদ করে এক অত্যুঙ্গ অবস্থানে নিজেকে প্রতিস্থাপন করেছেন কবি। ২য় অনুচ্ছেদে প্রকাশ ঘটিয়েছেন তার নিজস্ব চঞ্চল শক্তির অভিব্যক্তি। তিনি সর্বদাই যেনো শক্তি ও সুন্দরের সাধনার পুজারী। তার সাধনাই তাকে অস্থির প্রবহমান জিবনীশক্তির চঞ্চল কবিতে পরিণত করেছে। শেষ পর্যন্ত ভগবানবুকে পদচিহ্ন এঁকে দেয়া এবং শুধু পদচিহ্ন আঁকাই নয়- বিধির বক্ষ ছিন্ন করাও ছিল তার উদ্দেশ। ( এই ভগবান ও বিধি বলতে তিনি তৎকালীন শাসক শ্রেণীকে বুঝিয়েছেন)। এতসব করার পেছনে ছিল মানুষের প্রতি কবির অকৃত্রিম ভালবাসা। তার মানবতাবোধ।
কবি নজরুল হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান প্রভৃতি ধর্মের সারটুকু গ্রহণ করেছেন। তাই তিনি বিশেষ ধর্মের কবি নন। জাতি ভেদ তার কাছে নেই। তিনি সমস্ত মানব জাতির কবি। নির্যাতিত মানবতার মুক্তির সাধক।
জাতীয় জীবন যখন ঘনান্ধকারে, মানুষের জীবন যখন ছিল বিদেশী শাসনের নাগপাশে আবদ্ধ- ঠিক তখনই এক এক অকৃত্রিম সহমর্মিতা ও সহানুভূতির সুর নিয়ে বাংলা সাহিত্য গগনে আবির্ভাব ঘটে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের। তিনি উপলব্ধি করেন – মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহিয়ান। তাই নিবিড় সহানুভূতি বজ্রাগ্নির মতো অসহনীয় উত্তাপে ফুটে ওঠে নজরুল কাব্যে। বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার বিদ্রোহী সত্ত্বার।
বলবীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির
বলবীর
বল মহা বিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি
চন্দ্র, সূর্য, গ্রহতারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক, গোলক ভেদিয়া
উঠিয়াছি চির বিশ্বয় আমি বিশ্ব বিধাত্রির।
আর এখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে নজরুলের অকৃত্রিম মানবতাবোধ। নজরুল যে চার দশক সচেতন জীবন যাপন করেছেন- তখন তিনি দেখেছেন রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে মানব অবস্থানের পরিবর্তন, তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের বিপ্লবে মুসলমানদের বন্ধনদশা থেকে মুক্তিলাভ সহ পূর্বে ঘটে যাওয়া ফরাসী ও আমেরিকান বিপ্লবের ঘটনা – যার সমস্ত কিছুই কবিকে পাকাপোক্ত করে গড়ে তুলেছে একজন সচেতন মানবতাবাদী কবি হিসেবে। নজরুল হয়ে উঠেছেন সাম্যবাদী কবি।
তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষের রাজনীতি ছিলো দুটি ধারায় বিভক্ত। একটি সাম্প্রদায়িক( কংগ্রেস ও মুসলিমলীগ) অন্যটি অর্থনৈতিক(কমিউনিস্টপন্থী ) ধারা। নজরুল সাম্প্রদায়িক ধারার কৃত্রিমতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। অর্থনৈতিক ধারার কথাও বলেছেন। তাই তিনি লিখেছেন – সর্বহারা, সাম্যবাদী কবিতা। তিনি সাম্যবাদী মানুষের মধ্যে দেখেছেন সকল জ্ঞানের সমন্বয়।
সকল ধর্মের চেয়ে , তীর্থস্থানের চেয়ে, সকল অবতারের চেয়ে মানব হৃদয় শ্রেষ্ঠ- এটাই কবি বলতে চেয়েছেন অত্যন্ত জোরের সঙ্গে। তাই তো তিনি বলেছেন- এই হৃদয়ের চেয়ে বড় মন্দির কাবা নাই। মানুষ তার হৃদয়ের কাবাঘর বাদ দিয়ে স্রষ্টাকে খুঁজে ফেরে বাহিরে। এই ভ্রান্ত ধারণা তুলে ধরেছেন কবি। তিনি বলেছেন- ঈশ্বরকে জানতে হলে শাস্ত্র না ঘেঁটে “ডুব দাও সখা সত্য সিন্ধুজলে”। এভাবে নজরুল মানুষকে করেছেন মহিমান্বিত। রেখেছেন সবার উপরে। তার নারী, কুলি- মজুর ইত্যাদি কবিতাগুলি এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
সাধারণ মানুষের বন্দীদশা নজরুল যতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন- তেমন গভীরভাবে খুব কম কবিই তা অনুধাবন করেছেন। তার দারিদ্র, মানুষ, নারী ইত্যাদি এর প্রমাণ।
তুমি শুয়ে রবে তেতলার পরে আমরা রহিব নিচে
অথচ তোমারে দেবতা বলিব সে ভরসা আজ মিছে।
এমন কথা যিনি বলতে পারেন- তিনিই গণ মানুষের কবি, মানবতার কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি শোষণ বিরোধী কবি। অধিকার সচেতন কবি। তাই তিনি বিদ্রোহী। এই বিদ্রোহ শুধু তার বিদ্রোহী কবিতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি বিদ্রোহ করেছেন সমাজের অনাচার, অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে, অর্থনৈতিক মুক্তির অন্তরায়ের বিরুদ্ধে। তাই আমাদের জাতীয় কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানবতার কবি, গণ মানুষের কবি। পৃথিবী যতদিন বেঁচে থাকবে তিনিও ততদিন বেঁচে থাকবেন এই মানুষের মনে। আমরা কবির আত্মার শান্তি কামনা করি।

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।